Make a difference by posting your own unique contents

অধ্যায় চার

আমার নানা-নানী তাদের মেয়ের বিয়ের পর থেকে জামাইয়ের বাড়ীতেই থাকতেন। তারা ছিলেন খুবই দরিদ্র। শুনেছি, আমার নানা শিক্ষকতা করতেন; শেষ বয়সে, সম্ভবত, হেড-মাস্টারের পদটি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। জামাইয়ের আশ্রয়ে থাকার, জামাইয়ের কৃপা-প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারটা নানীকে অনবরত কষ্ট দিত; লজ্জায় এবং ভয়ে আমার বাবার কাছ থেকে তিনি সর্বদাই যেন লুকিয়ে থাকতেন। আমার বাবা-মায়ের যখন বিয়ে হয়, হয়ত বা তার বেশ আগে থেকেই নানা শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়েছিলেন, যে কারণে নানী তার স্বামীকে নিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের আশ্রয়ে থাকতে বাধ্য হয়, যা স্বাভাবিক অবস্থায় (নানার চাকরী থাকলে) হয়ত তিনি করতেন না।

আমার জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে কৈশোরের শেষ দিনগুলোতে নানীর মৃত্যু পর্যন্ত, – তিনি আমার জীবন ও চেতনাকে, আমার বোধকে আচ্ছন্ন করে ছিলেন। আমার চরিত্র আর প্রকৃতি তার দ্বারা এত বেশি প্রভাবিত হয়েছিল যে, পরবর্তী জীবনের বহুলাংশে সে প্রভাবের দৃশ্যমান প্রতিফলন লক্ষ করে আমি নিজেই বিস্মিত হই। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে বছরে বছরে জমে ওঠা পরম স্নেহ আর মমতার স্পর্শ আর সান্নিধ্য তার প্রতি আমার কোমল শিশু-মনে যে অসীম বিশ্বাস আর আস্থার জন্ম দিয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতেই এটা সম্ভব হয়েছে।

আমার মা-বাবা খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন, যখন তারা নিজেরাই শিশু বই অন্য কিছু নয়; বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া তো অনেক পরের কথা, সংসার-ধর্ম কী, তা-ই হয়ত ওই অল্প বয়সে তারা ভালো করে জানত না। মা-বাবার বিয়ের প্রথম বছরের শেষের দিকেই এই ধরায় আমার আগমন ঘটে। জন্মের পর থেকে নানীর স্নেহ-মমতার সুশীতল ছায়ায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকি। শুনতে পাই, শৈশবের সেই সব মায়াময় দিনগুলোতে নানীর এত কাছে আর মায়ের এত দূরে ছিলাম যে, কোথাও থেকে বেড়িয়ে বাসায় ফিরবার পরে মা যখন আমাকে হাত নেড়ে ডাকতেন আমি তখন নানীর কোলে চোড়ে বড় এক হা করে, ড্যাবড্যাব চোখে দূর থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম – যেন তাকে চিনি না, অথবা চিনতে কষ্ট হচ্ছে; যেন আমার নানীই আমার আসল মা, আর দূরে দাড়িয়ে থাকা মহিলাটি সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো নারী।

শৈশব থেকেই আমার অভ্যাস হয়ে যায় নানীর শাড়ীর আঁচল নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে শোয়ার। যখন কিশোর, স্কুলে পড়ি, তখনকার এমন একটি রাতের কথাও মনে পড়ে না, যে রাতে নানীর সাদা সূতি-শাড়ীর নরম আঁচলে মুখ গুজে ঘুমোতে যাইনি। নানীকে সবসময় সাদা সূতি-শাড়ী পড়ে থাকতে দেখেছি; অতি ব্যবহারে নরম হয়ে যাওয়া সেই শাড়ী আমার কাছে ঘুমের ওষুধের মতো ছিল; সেই শাড়ীর আঁচল দলা পাঁকিয়ে নাকে চেপে ধরলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, স্বর্গের চাবিটা যেন হাতে চলে আসত; সেই চাবি দিয়ে কত সহস্র রাতে স্বর্গের দরজা খুলে অপার শান্তিময় ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করেছি।

কৈশোরে একটি চাঁদর গায়ে জড়িয়ে ঘুমোতাম। ক্রমাগত অনেক দিন ধরে ব্যবহারের ফলে সে চাঁদরটা ক্রমশ খুবই নরম আর আরামদায়ক হয়ে ওঠে। মজার ব্যাপারটি হলো, এই চাঁদরটির সাথে ধীরে ধীরে নানীর আঁচলের এক অদৃশ্য যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল, যার ফলে শুধু তার আঁচলটিই নয় বরং সেই সাথে চাঁদরটিও আমার কাছে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। নানীর পরলোক গমনের পরেও বহুদিন, ছিড়ে কুটিকুটি হওয়ার আগ পর্যন্ত, সেই চাঁদরটি গায়ে জড়িয়ে ঘুমোতে যেতাম। মনে হত যেন সেই চাঁদরের মধ্যে নানীর নরম আঁচলের সুমিষ্ট আর সুশীতল গন্ধ সংক্রমিত হয়ে সেখানে তা স্থায়ী আসন গেড়েছে।

নানী, খুব সম্ভব, ওলি ছিলেন; যে কারণে তিনি সকল শ্রেনীর মানুষকে সমান চোখে দেখতেন; উচুঁ-নীচুঁ, ধনী-দরিদ্র – এসবের অস্তিত্ব তার জগৎে ছিল না; আর এরই প্রতিফলন ঘটতে দেখেছি তার দৈনন্দিন কাজ-কর্মে। নানী গৃহপরিচারক গৃহপরিচারিকাদের কাজের তদারকি করতেন; তারা ঠিক মত টেবিলে খাবার দিচ্ছে কিনা দেখতেন; কিন্তু কখনোই আমি তাকে আমাদের সাথে একই টেবিলে খেতে দেখিনি। এই নিয়ম তিনি তার মৃত্যু পর্যন্ত বহাল রেখেছিলেন। বাড়ীতে যারা কর্মরত ছিল, রান্নাঘরে রান্নাবান্নার কাজ করত অথবা বাড়ীর অন্যত্র ঘর মোছা, ঘর ঝাড়– দেবার মতো অন্যান্য কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকত; তিনি খাওয়ার পর্বটা সারতেন তাদেরও পরে; বাড়ীর কাজের লোকদের খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছে কি না, তারা ভালো খাচ্ছে কি না এসব দেখাশুনার পরে সবার শেষে তিনি খেতে বসতেন।

এই নিয়ম দীর্ঘ দিন ধরে চলেছিল, এবং এর কোনো অন্যথায় হতে কখনোই দেখিনি। উনি এরকমটি করতেন কেন? এমন তো নয় যে, উনি চাইলেও আমাদের সাথে একসাথে বসে একই টেবিলে খেতে পারতেন না। হয়ত বা উনি আমার বাবাকে এড়িয়ে চলতে চাইতেন, তাই তার সাথে একই টেবিলে বসে খাবার খেতেন না। জামাইয়ের বাড়ীতে আশ্রিতের মতো থাকতে হচ্ছে বলে তিনি সবসময় সংকুচিত থাকতেন, যদিও তার প্রতি বাবার আচরনেণ কখনোই মর্যাদা হানিকর কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যায় নি। তবে, এখন যখন ভাবি তখন কখনোই এটাকে নানীর এই আচরণের মূল এবং পেছনের কারণ বলে মনে হয় না।

নানী সবমসয় সাধারণ মানুষের সাথে সাধারণ জীবন যাপনে আগ্রহী ছিলেন, এবং সে ধরনের জীবন যাপন করতে পছন্দ করতেন। গাড়ী-চালক, গৃৃহ-পরিচারক অথবা গৃৃহ-পরিচারিকা, এবং অন্যান্যদের যারা দরিদ্র এবং বঞ্চিত সুগভীর স্নেহ ও মমতায় আগলে রাখতেন। তিনি জীবনে কখনো কোনো কিছু একলা ভোগ করেননি। বাড়ীতে ভালো খাবার-দাবার কিছু করা হলে, বাড়ীর সকলের মাঝে তা বন্টন করে দিতেন; যদি কিছু অবশিষ্ট থাকত, পরে তা খেতেন (বেশিরভাগ সময় কিছুই অবশিষ্ট থাকত না)। আর এই বন্টন প্রক্রিয়া থেকে গৃহপরিচারক অথবা পরিচারিকা এবং বাড়িতে অন্যান্য আর যারা কর্মরত ছিল, তারা কখনোই বাদ পরেনি। কে জানে, ঠিক একই ভাবে হয়ত তিনি তাদের সুখ-দুঃখও ভাগ করে নিতেন। তার প্রকৃতির অন্তর্নিহিত এইসব গুনাবলীর কারণেই হয়ত তিনি ইচ্ছে করেই আমাদের সাথে এক টেবিলে কখনোই খেতে বসেননি, বরং সবসময় তার আহারপর্ব সম্পন্ন করেছেন রান্নাঘরে, সবার শেষে।

Share Now:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *