খুব ছোট বেলা থেকে আমার চরিত্রে একটা অদ্ভূত বৈশিষ্টের সূচনা হয়: আমার অন্তরে টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র, আর অর্থ-সম্পদের কোনো লোভ ছিল না, সেই ছোটবেলা থেকেই। জ্ঞান হবার পর থেকে নানীকে আমি মায়ের মতো দেখেছি। তার সাথে আমার সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, আধো অচেতন আধো জাগরণে কখনো কখনো তাকে ”মা” বলে ডেকেছি। আমার চরিত্রের নির্লোভীতার দিকটি, যা শৈশবের সেই দিনগুলো থেকেই জাগরুক, হয়ত নানীর কাছ থেকেই পেয়েছি; অথবা এমনও হতে পারে, এই নির্লোভীতা আমার অস্তিত্বের অংশ, যা আজ পর্যন্ত অটুট আছে (কিন্তু, মানুষ এই পৃথিবীতে হয়ত কখনোই সম্পূর্ণরূপে নির্লোভ হতে পারে না; তার লোভ কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনো দিকে বিস্তার লাভ করবেই; সেই লোভকে অতিক্রম করে তাকে আলোর পথে অগ্রসর হতে হয়। এই পৃথিবীতে মানুষের জন্যে একটাই আশার বাণী: কোনো কিছুর ভেতরে ঢোকার যেমন রাস্তা আছে, তেমনি বেরুবার রাস্তাও আছে। মানুষ শুধু অন্ধকার গলিতে মাথা ঠুকে ঠুকে মরে না, সে আলোর সন্ধানও করে; অন্ধকার রন্দ্রপথের কোথাও না কোথাও আলোর হাতছানি থাকে বলেই – সে মরে না, মুক্তির আশা নিয়ে বেঁচে থাকে।)।
চরিত্রের এই নির্লোভীতার দিকটি শৈশব থেকেই নানা রূপে প্রকাশ পাচ্ছিল। এখনও স্পষ্ট মনে আছে ছোটবেলায় কিভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের শোবার ঘরের ড্রয়ার থেকে অথবা হাতব্যাগ থেকে ১০০ টাকা আর ৫০০ টাকার নোটগুলো নিয়ে জানালা দিয়ে নির্দ্বিধায় ফেলে দিতাম। এভাবে লুকিয়ে কত যে ১০০ টাকা আর ৫০০ টাকার নোট ফেলেছি, তার কোন হিসেব নেই।
ছোটবেলা থেকেই বস্তুগত জিনিসের প্রতি আমার তেমন কোন আকর্ষণ ছিল না যা ছিল তা হল কৌতূহল; সেই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে খেলনাগুলো নির্দ্বিধায় ভেঙ্গে ফেলতাম, এটা দেখার জন্যে যে সেগুলোর ভেতরে কি আছে; সেগুলোর গোপন সংগঠণ উন্মোচিত করে তাদের নড়াচড়ার কার্য-কারণ জানতে চাইতাম, সেই অত্ত ছোট্ট বয়স থেকেই। আরও পরে, কৈশোরে কত রাতে নিভৃত নিঃস্তব্ধ ছাদে বাবার সাথে পায়চারী করবার সময় মাথা তুলে তাকিয়েছি স্বচ্ছ, নীল তারাভরা আকাশের দিকে: তারাগুলো কি ও কেন মনে প্রশ্ন জেগেছে কতবার।
ছোটবেলা থেকেই আমি প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসতাম, আর একাএকা সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। কথা প্রায় বলতামই না; আমার সব কথা যেন ছিল প্রকৃতির সঙ্গে, চুপিচুপি স্থির চোখের মণিতে, অথবা ওষ্ঠাধরের মৃদু কম্পনে। হয়ত আমাকে নিয়ে মা-বাবা বেড়াতে গিয়েছে তাদের কোনো বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের বাসায়, সেখানে বাবার কাধে মাথা রেখে নিদ্রায় বিভোর হয়েছি; এমনটি ঘটেছে কতবার তার কোনো লেখাজোখা নেই। রাগ প্রায় করতামই না; যদিও বা কখনো সখনো অভিমান হত কোনো কারণে, ঠোট দুটো ফুলতে থাকত প্রায় মিনিট পনেরো-বিশ সবার অজ্ঞাতসারে এবং নিরবে তারপরই সেকি কান্না, মিষ্টি-মধুর অভিমানে ভরা; চোখে যত না জল ঝরত, ঠোট নড়ত তার চেয়ে বেশী।
ছোটবেলা থেকেই আমার নেশা ছিল মাটির জিনিস বানানো; কত রকমের মাটির জিনিস কত পরম যত্নে যে বানিয়েছি; এ কাজে আমার একনিষ্ঠ সহযোগী ছিল নীরা, আমার বোন। তখনকার মাটি কেমন কালো আর নরম ছিল; গ্রীষ্মের তাপে গলে যাওয়া কালো চকলেটের মতো নরম সেই মাটি আমার ছোট্ট ছোট্ট হাতে কেমন অতি সহজেই তালগোল পাকিয়ে আমার পছন্দের বিভিন্ন রূপ নিত; দুপুরের খরতাপে অথবা বিকেলের পড়ন্ত রোদে, ছাদের কিম্বা পানির ট্যাঙ্কের ওপরে (কেউ পারা দেবে অথবা নষ্ট করবে সেই ভয়ে মাটির তৈরী জিনিসগুলোকে আমরা প্রায়ই ছাদে, পানির ট্যাঙ্কের ওপরে শুকোতে দিতাম) সেগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে স্থায়ী আকৃতিতে পরিণত হত।