Make a difference by posting your own unique contents

অধ্যায় পাঁচ

নানীকে দু’একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কখনোই রাগ করতে দেখিনি। আমার সাথে উনি একবার মাত্র রাগ করেছিলেন। সেদিন আমার বাবা-জ্যাঠাদের লবনের ব্যবসায় লবন পরিবহনের জন্যে সদ্য ক্রয় করা জাহাজে মিলাদ পড়ানো হয়। সেই মিলাদের মিষ্টি বাসায় নিয়ে এসে তার সবটা আমি একাই খেতে চাইছিলাম। আর নানী চাইছিলো আমি বাসার সবার সাথে মিষ্টি ভাগ করে খাই। তার সেই কথা না শোনাতে তিনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হোলেন, এবং মিষ্টির ঠোঙ্গাটা দূরে ছুড়ে মারলেন; বললেন, “নে, সব খা”। আসলে তিনি সেই সময় আমাকে ঠিক কি বলেছিলেন, তা হুবহু মনে নেই; তবে এধরনের কিছু একটা যে বলেছিলেন, তা বেশ মনে আছে। আরও একবার নানীকে রাগতে দেখেছিলাম। সেই ঘটনার কথা যথা সময়ে বলব।

শৈশব থেকেই আমার যে কোনো রকমের মিষ্টি খাবারের প্রতি প্রবল আকর্ষন ছিল। আম, মিষ্টি এবং অন্য যেকোনো রকমের মিষ্টি খাবার আমার কারণে বাসায় রাখা যেত না। কত নিঝুম ঘুম-ধরা দুপুরে একটার পর একটা আম খেয়ে বিছানার নীচে লুকিয়ে রাখা আমভর্তি ঝুড়ি শূন্য করে দিয়েছি। সেই সময়ের সেই আমের মতো মিষ্টি আম এখন আর পাওয়া যায় না; পাতলা খোসা আমের গায়ে মাখনের মতো লেগে থাকত; আমার ছোট্ট নরম হাতের আলতো স্পর্শেই তা অনায়াসে উঠে আসত; তাই, খোসা ছাড়িয়ে একের পর এক আস্ত আম চুষে আর চিবিয়ে খেতে কোনো ক্লান্তি ছিল না। ঠিক একইভাবে ফ্রিজে রাখা রসগোল্লা, লালমোহন ইত্যাদি মিষ্টান্নগুলো চুুপিসারে মুখে তুলে নিতেও কসুর করিনি কখনো।

যত সমস্যা হত ভাত খাওয়া নিয়ে; ভাত নিজের হাতে খেতাম না, নানীকে খাইয়ে দিতে হত। নানী আমাকে কত কষ্ট করে ধীরে ধীরে বড় করে তুলেছেন সে কাহিনী শুনলে রূপ কথার মতো মনে হবে। সেই খুব ছোট বয়স থেকে, যখন সবেমাত্র ভাত খেতে শুরু করেছি, তখন থেকেই নানী আমাকে নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিতেন। পৃথিবীতে অমৃত বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেটা ছিল নানীর হাতের সেই ঝোল-মাংস আর আলু মাখানো ভাত। সেই ভাত খাওয়ানোর পদ্ধতিটাও ছিল বড় কৌত‚হলোদ্দীপক।

ভাত খাওয়ানোর সময়টাতে কখনোই এক জায়গায় বসে থাকতাম না; এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ছুটোছুটি করতাম। আর নানীর কাজ ছিল আমার পিছুপিছু ছুটে বেড়িয়ে আমাকে খাওয়ানো। পরম মমতা আর ¯েœহের সাথে তিনি এই কাজটি করতেন। কিভাবে করতেন? হয়ত এক কামরা থেকে আরেক কামরায় ছুটে গেলাম, তিনিও নিঃশব্দে এবং ধীর পদক্ষেপে আমার পিছুপিছু ভাতের থালা হাতে আসলেন; অতঃপর, আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই পেছন থেকে এক নলা মাংসের ঝোল, আলু, আর মাংসের টুকরো মাখানো ভাত আমার মুখে পুড়ে দিতেন। কৈশোরের একটা লম্বা সময় ধরে এই অবস্থাটা চলেছিল।

শৈশবে খুব শান্ত থাকলেও, কৈশোরে খুবই উদ্দীপ্ত; প্রাণময় আর চঞ্চল হয়ে উঠি। এই চাঞ্চল্য, উদ্দীপনা, আর প্রাণময়তা মূলতঃ দৈহিক ছিল। আর সেই প্রাণময়; উদ্দীপিত আর চঞ্চল দেহের ভেতরে যে মনটা ছিল, সেই মনটা তখনো শৈশবের শান্তি আর স্থিতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছিল। স্কুলজীবনে খুবই দুর্দান্ত ছিলাম; পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা আর ছুটাছুটিতেই সারাদিন পার করে দিতাম। এভাবে সারাদিন রোদে বৃষ্টিতে ছুটাছুটি করবার কারণে অথবা অন্য যে কোনো কারণে আমার খানিকটা জ¦র উঠলে কিম্বা গা গরম হলে, নানী একটা অদ্ভূত কান্ড করতেন; এবং সেই কান্ডের ফলাফলটাও খুবই অদ্ভ‚ত ছিল।

এখানে একটা কথা বলে নেওয়া জরুরী – শৈশবে, বিশেষ করে কৈশোরে, অদ্ভূত রকমের রূপবান ছিলাম; যা খুবসম্ভব সকলের দৃষ্টি কারত। আমার কোন অসুখ- বিসুখ হলেই নানী মনে করতেন আমার ওপরে কারো নজর লেগেছে (আমার অপরূপ রূপের কারণে, যা শৈশব থেকে কৈশোরে কাঁচা আম ক্রমান্বয়ে পেঁকে যাওয়ার মতো খোলতাই হয়েছিল); তখন তিনি আমার ওপর থেকে সেই নজর ওঠাবার (বা সরাবার) কাজে লেগে যেতেন। কিভাবে তিনি তা করতেন? সে এক অদ্ভূত পদ্ধতি। প্রথমে তিনি আমাকে চিত করে শুইয়ে দিতেন; অতঃপর কতগুলো ভেজা পানপাতা একসাথ করে সাতবার আমার আপদমস্তক সেই ভেজা পানপাতায় আলতো করে ছোয়াতেন, আর একই সাথে বিড়বিড় করে কি যেন সব দোয়া পড়া চলত। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পরে তিনি ভেজা পান পাতাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিতেন। আর সেগুলো ফটাস্ফটাস্ শব্দে পুড়তে থাকত। কি করে কতগুলো প্রায় চুপচুপে-ভেজা পানপাতা আগুনে ফটাস্ফটাস্ শব্দে পুড়তে পারে (যেন কোনো শুকনো কাঠ জলন্ত আগুনে পুড়ছে), সে রহস্য আমি আজও বুঝিনি। নানী আমাকে বলতেন, “দেখ, নজর পুড়ছে”। এখন যখন ভাবতে বসি তখন কেন জানি আমার কাছে ব্যাপারটাকে অনেকাংশে সত্য বলেই মনে হয়। এমনতো বহুবার ঘটেছে যে, আত্মীয়-স্বজনেরা অথবা অন্য কেউ বাসায় অতিথি হয়ে এসে চলে যাবার অব্যবহিত পরেই ছোট-বড় অসুখ-বিসুখে পড়েছি ।

নানীকে কখনোই তাহাজ্জুদের নামাজ কাজা করতে দেখিনি। কামরার এক কোনায় নামাজ পড়ার জন্যে ওনার একটি ছোটচৌকির মত ছিল। সেখানে জায়নামাজ বিছিয়ে উনি বসতেন। যখনই রান্নাবান্নার তদারকি বা ঘরের অন্যান্য কাজ থেকে ফুরসত পেতেন, তখনই তিনি ঐ চৌকিটার পরিসীমার মাঝখানে আশ্রয় নিতেন। ওনার কাছে কোরআন শরীফ ছাড়াও ইয়াসীন সূরাসহ কোরআন শরীফের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূরার একটি সংকলন ছিল (এই ধরনের সংকলনকে অযিফা বলা হয়)। ঐ ছোট্ট চৌকিতে বসে আসরের; মাগরিবের; এশার; এবং ফজরের নামাজ শেষে কত হাজারবার যে তিনি ঐ ছোট্ট নীলমলাটে বাধানো অযিফাটি আগাগোড়া তিলাওয়াত করে শেষ করেছেন, তার হিসেব মেলানো কঠিন। সেইসব প্রাণোচ্ছল কৈশোরের দিনগুলোতে বারবার তার হাতে ঐ কিতাবটি দেখেছি; আর শুনেছি “ইয়া-সীন” শব্দটি লম্বাটানে উচ্চারণ করতে; সেই সমস্ত মুহূর্তে আমার কিশোর হৃদয় তেমন কিছু না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতো যে, ঐ শব্দগুচ্ছ কোন কিছুর সূচনা নির্দেশ করে ।

নানীর হাত কখনোই তসবীশূন্য দেখিনি; কোনো এক ওয়াক্তের নামাজ পড়ে তসবী হাতে নেয়ার পর, পরবর্তী ওয়াক্তের নামাজে দাড়াবার আগ পর্যন্ত তা তার হাতেই থাকত; শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেই তসবী কখনো তার হাতছাড়া হতে দেখিনি (সেই তসবীগুলোও ছিল বিভিন্ন মনোহারী বর্ণের এবং অদ্ভ‚ত আকার-আকৃতির)। এমন নয় যে তিনি অভ্যাসবসে তসবী নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন; আমার বিশ^াস, এই কাজটা তিনি সদা এবং সর্বত্র সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণের আঙ্গিনার মধ্যে রাখবার জন্যেই করতেন।

নানীর ঝুলিতে ছিল বিভিন্ন দোয়া-দোরুদের অফুরন্ত ভান্ডার; যখনই শরীর খারাপ করত, তিনি একটি বিশেষ দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফু দিতেন। এখন মনে হয়, সেই দোয়াটা তিনি বিশেষভাবে আমার জন্যেই প্রস্তুত করেছিলেন। কারণ, সে দোয়ার একটা জায়গায় আমার নামটি আমি শুনতে পেতাম; আরবী ভাষার দীর্ঘ দোয়ার কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু সেই দোয়ার শেষ কয়েকটি শব্দ এখনও আমার কানে লেগে আছে : “সবুজ, চশ্মে বদ্দুর চাঁদ”। আমার বিশ^াস নানীর এই দোয়া তার মৃত্যুর পরেও সঙ্গী হয়ে আমার সাথে সাথে আছে। নানীর শরীর ভীষণ শীতল ছিল, ঠিক যেমনটা শান্ত আর শীতল ছিল তার মন। মাঝেমধ্যেই আমাকে তার ঘামাচিতে ভরা পিঠ নখ দিয়ে আচড়ে দিতে হত। সেই সময়গুলোতে তার পিঠে হাত দিয়ে তার শরীরের শীতলতা অনুভব করতে পারতাম।

সম্ভবত, নানী লেখা-পড়া খুব বেশী করেন নি। তবে, তিনি পড়তে পারতেন; লিখতে পারতেন কিনা জানি না (তাকে কখনও লিখতে দেখিনি।)। সে সময়ে মহিলাদের একটি পত্রিকা বাজারে খুব চলত, নাম ছিল “বেগম”। নানী ছিলেন খুবই পাতলা আর অনেক লম্বা, আয়তাকৃতির নিউজপ্রিন্টের এই পত্রিকাটির নিয়মিত এবং একনিষ্ঠ পাঠক। কোনো কোনো দিনে, আসরের নামাজ আদায়ের কিছুক্ষণ পর তিনি বেগম পত্রিকাটি নিয়ে বসতেন। নামাজপড়ার চৌকিটার সামনেই ছিল পশ্চিমের জানালা; সন্ধ্যায়, সূর্যাস্তের অনেক পরেও সেই জানালা দিয়ে নীলাভ-সাদা আলো আসত; সন্ধ্যার সেই আলো-আধারীতে জানালার খুব কাছে বসে, গভীর আগ্রহ নিয়ে তিনি সেই “বেগম” পত্রিকাটির পাতা উল্টোতেন; আলোকস্বল্পতার কারণে তার পড়তে কষ্ট হত, যার ফলশ্রæতিতে তার মাথাটা মাঝেমধ্যেই পত্রিকার ওপরে ঝুঁকে পরত; অথবা পড়বার সুবিধার জন্যে পত্রিকাটিকে চোখের অনেক কাছাকাছি নিয়ে আসতেন (নানীর মোটাফ্রেমের একটি কালো চশমা ছিল; তবে, সেই চশমাটি তিনি কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন। তার দৃষ্টিশক্তি আসলে স্বাভাবিকের চাইতেও অনেক ভালো ছিল)। বেগম পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য বইপত্রও তিনি মাঝেমধ্যে পড়তেন।

তিনি নিজে যেমন অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন, ঠিক তেমনি সহজ-সরল গল্প বলতে এবং পড়তে ভালোবাসতেন। ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি প্রায়ই আমাকে একটা গল্প বলতেন; ভাত খাওয়ানো শুরু হলে সেই গল্প বলাও শুরু হত, আর কখন যে সেই গল্প শোনার ফাঁকে ফাঁকে থালাভর্তি ভাত খাওয়া শেষ হয়ে যেত তা বুঝতেও পারতাম না। গল্পটা আমার কিশোর হৃদয়কে যাদুমন্ত্রের মতো আকর্ষণ করত। কি ছিল সেই গল্প? সেই গল্পটা ছিল ইউসুফ-জুলেখার গল্প। জুলেখাকে (যে নাকি ছিল রাজকন্যা) এক দৈত্য এক সুগভীর এবং প্রায় জল-শূন্য কুয়ার তলদেশে বন্দী করে রাখে। দৈত্যের প্রাণ ছিল এক কালো ভ্রমরার মধ্যে; ইউসুফ (গল্পের নায়ক) সেই ভ্রমরকে হত্যা করে জুলেখাকে সেই অন্ধকার কুয়ার বন্দী-দশা থেকে উদ্ধার করে। নানীর মুখে সেই গল্প বারংবার শুনতে শুনতে হয়ত হঠাৎ করেই কোনো এক সময় কৈশোরের অবচেতন অন্তরে ইউসুফ হওয়ার স্বাদ জেগেছিল; অন্ততঃ এখন তো তাই-ই মনে হয়।

Share Now:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *