শৈশবের প্রথম দিককার সময়ের কথা কোন মানুষের-ই মনে থাকে না। সে সময়টা মানুষের জীবনের এমন একটা সময় যখন পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব থাকলেও তা নিজের কাছে প্রতীয়মান হয় না। সেই সময় আমি নাকি বাসা সংলগ্ন মাটির ছোট আঙ্গিনায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতাম; নির্বিচারে গলাধঃকরণ করতাম আঙ্গিনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট পাথর, কঙ্কর, আর মাটি।
আমার শৈশবটা ছিল আসলে রূপকথার মত; শৈশবের যে সময়টার কথা মানুষের মনে থাকে, সে সময়টার কথা বলছি। সে সময়ে আমার সময় কাটতো আকাশে মেঘের খেলা দেখে। গ্রীষ্মের নীলাকাশে প্রতিটি বিচ্ছিন্ন মেঘপুঞ্জ – সাদা, জলহীন – আমার সরল, কৌতূহলী চোখের তাড়ায় আটকে যেতো। প্রতিটি বাসা-বাড়ীর জানালার ভেতরের দিকটায় সে সময়ে একটা করে বর্ধিতাংশ থাকতো, যেখানে ইচ্ছে করলে বসাও যেতো – এত প্রস্বস্ত ছিল সেগুলো; সেই বর্ধিতাংশে বসা ছোট্ট আমি দুহাতে জানালার গ্রীল ধরে অপলক আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম; দেখতাম গ্রীষ্মের শান্ত নীল আকাশের সু-বৃহৎ প্রচ্ছদপটে সেই সব সাদা, জলহীন মেঘপুঞ্জের অবাধ বিস্তার; মানুষের চেহারার অবয়বে কল্পনা করতাম তাদের। যেন আমি একা নই; আমাকে সঙ্গ দিতে গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে নির্মল রৌদ্র-বিদগ্ধ আকাশে তৈরী হচ্ছে নানা অবয়বের মুখাকৃতি – কোনোটা শশ্রুময় বৃদ্ধের প্রজ্ঞার্কীণ মুখ, কোনোটা যুবা পুরুষের।
প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির আগে এই খেলাটা আরো জমত বেশী। অবাক হয়ে দেখতাম আকাশের কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রান্তে কালো কালো মেঘের ফুল ফুটে ছড়িয়ে পড়ছে তা আকাশের সর্বত্র। কালো মেঘ বাধা-বিঘ্নহীন ধোঁয়ার মতন দিগন্ত বেয়ে উঠে পুঞ্জে পুঞ্জে স্তরে স্তরে নামত অন্য দিগন্তে; তাদের সেই সর্বগ্রাসী বিস্তার আমার শিশু-মনকে খুবই পুলকিত, খুবই চঞ্চল করত। সেই শৈশবেই ঝড়ের সেই নিঃশব্দ, অথচ নিগূঢ় প্রক্রিয়া যেন আমার রক্তে দোলা দিত; মনে মনে কামনা করতাম আকাশটা যেন আরও একটু কালো হয়, যেন ওতেই আনন্দ। আকাশে মেঘের এই ঘনঘটা যে আসন্ন ঝড় আর ধ্বংসেরই পূর্বাভাস সে আমি বেশ বুঝতাম; তারপরও, যেন সেই ধ্বংসই আমার কাম্য ছিল।
খাওয়া-দাওয়ার পরে, দুপুরে আমাকে একা বিছানায় শুইয়ে রেখে চলে যেত আমার মা; আমি ঘুমোবার ভান করতাম, আসলে ঘুমাতাম না। গ্রীষ্মের “রোদ-খর খর” দুপুরে নিদ্রা-বিভোর সূর্যালোক যখন স্বপ্নের রংএ নানা বর্ণের ছবি আঁকছে, তখন আমি আমার কোল-বালিশটাকে দুই উরুর মাঝে ঠেসে দিয়ে শুয়ে থাকতাম; আহ, কি আরাম; কি অদ্ভূত একটা নিরাপত্তার বোধ তখন আচ্ছন্ন করত আমার ছোট্ট শিশুর অন্তরটাকে। জানালাগুলোর ফাঁক ফোঁকর দিয়ে, পর্দার ফাঁক গলে অপরাহ্নের রোদ এসে খেলা করত আমার সংগে; অপরাহ্নের সেই নিঃশব্দ রোদ আমার শিশু মনে যে নেশা জাগাতো তার কোন তুলনা হয় না। আমাকে একা শুইয়ে রেখে চলে যাওয়ার আগে মা কামরার সমস্ত জানালার পর্দাগুলো টেনে দিত। সেই পর্দার ওপরে এসে বাইরের পৃথিবীর আলো থমকে দাড়ালেও, সেই আলোর মাদকতাময় এবং নিমন্ত্রণমূলক ইঙ্গিতময়তা কামরার সর্বত্র ছড়িয়ে থাকত।
শৈশবে আমার অনেকগুলো ছোট ছোট ছবিতে-গল্পের বই ছিল; বই বললে অবশ্য ভুল বলা হবে, সেগুলো আসলে ছিল চটিবই; যার অধিকাংশই সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বা সোভিয়েত কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হত। ওই ছবিতে-গল্পের চটিবইগুলো ছিল আমার প্রাণের চাইতেও প্রিয়। প্রায় চল্লিশটার মতো বইয়ের ছবিগুলো যেমন ছিল বিচিত্র বর্ণের আর সুন্দর, সেগুলোর গল্প আর চরিত্রগুলোও ছিল ঠিক তেমনি মনোমুগদ্ধকর। শৈশবের কত নেশা ধরানো রোদ-খরখর ঝিম-ধরা দুপুরে মাথার পাশে সেই বইয়ের স্তূপ নিয়ে শুয়ে থেকেছি। সেই বইগুলোর অনেক গল্পের অনেক চরিত্র নির্ভীকতায় অনন্য, পরবর্তী জীবনে আমার যৌবনে প্রেরণার উৎস হয়েছে। ‘যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আঁশ’, ‘রাত পোহালে বুদ্ধি বাড়ে’ – গল্পের এসব কথা যে যৌবনের দিশারী স্বরূপ, অন্ধকারে আলোর প্রদীপ; তা পরবর্তী জীবনে, যখন বুদ্ধি আঘাতে আঘাতে পরিপক্ক হয়েছে, তখন বুঝতে পেরেছি।